ইরান-রাশিয়া Su-35 চুক্তি নিশ্চিত: মধ্যপ্রাচ্যের শক্তি ভারসাম্যে নতুন মোড়
তারিখ: ৭ জুলাই, ২০২৫ইরান এবং রাশিয়ার মধ্যে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত Su-35 ফাইটার জেট সরবরাহ চুক্তি অবশেষে নিশ্চিত হয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। এই চুক্তি, যা ২০২৩ সালে চূড়ান্ত হয়েছিল বলে জানা গেছে, ইরানের বিমান বাহিনীকে আধুনিকীকরণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে, এই চুক্তির পথে বেশ কিছু বাধা এবং বিলম্বের সম্মুখীন হতে হয়েছে, যা সম্প্রতি বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত হয়েছে।

চুক্তির বিবরণ
২০২৩ সালে ইরান এবং রাশিয়া Su-35 ফ্ল্যাঙ্কার-ই ফাইটার জেট সরবরাহের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির আওতায় ইরানের প্রায় ৫০টি Su-35 জেট কেনার কথা ছিল, যা মূলত মিশরের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। মিশর ২০১৮ সালে ২৪টি জেটের জন্য ২ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করলেও, যুক্তরাষ্ট্রের CAATSA (Countering America’s Adversaries Through Sanctions Act) আইনের চাপ এবং জেটগুলোর রাডার, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ ব্যবস্থা এবং ইঞ্জিনের ত্রুটির কারণে ২০২০ সালে সেই চুক্তি বাতিল করে। ফলস্বরূপ, রাশিয়া এই জেটগুলো ইরানের দিকে পুনর্নির্দেশিত করে।
ইরানের বিমান বাহিনী বর্তমানে পুরোনো আমেরিকান F-14 টমক্যাট, F-4 ফ্যান্টম II এবং F-5 টাইগার II জেটের উপর নির্ভরশীল। Su-35, একটি ৪.৫ প্রজন্মের মাল্টিরোল ফাইটার জেট, ইরানের বিমান বাহিনীকে উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী করতে পারে।
তবে, সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালের চুক্তির পর থেকে মাত্র চারটি জেট ইরানে পৌঁছেছে, যা চুক্তির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
বিলম্বের কারণ
ইরানের কাছে Su-35 সরবরাহে বিলম্বের জন্য রাশিয়ার চলমান ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা হচ্ছে। ইউক্রেনের সূত্র অনুযায়ী, রাশিয়া তার নিজস্ব Su-35 বহরের ৪০% হারিয়েছে, যা তাদের উৎপাদন ক্ষমতার উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এছাড়াও, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্প সরবরাহ শৃঙ্খলার সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এই বিলম্ব ইরানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান হতাশার জন্ম দিয়েছে, এবং কিছু রিপোর্টে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে ইরান রাশিয়ার পরিবর্তে চীনের J-10C ফাইটার জেট কেনার দিকে ঝুঁকছে।
২০২৫ সালের মার্চে জানা যায় যে ইরানের জন্য নির্ধারিত কিছু Su-35 জেট আলজেরিয়ার কাছে সরবরাহ করা হয়েছে, যা ইরান-রাশিয়া সম্পর্কের মধ্যে আরও উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি গত জুন মাসে মস্কো সফরে গিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে বৈঠক করেন, যেখানে তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির একটি চিঠি পৌঁছে দেন।
ইরানের কৌশলগত প্রয়োজনীয়তা
ইরানের বিমান বাহিনী সম্প্রতি ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ বিমান হামলার মুখোমুখি হয়েছে, যা তাদের পুরোনো বিমান বহরের দুর্বলতাকে প্রকাশ করেছে। জুন ২০২৫-এ ইসরায়েলের “অপারেশন রাইজিং লায়ন” এবং পরবর্তী মার্কিন হামলায় ইরানের প্রায় ৩০% বিমান ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করা হয়। এই পরিস্থিতি ইরানকে তার বিমান বাহিনীকে দ্রুত আধুনিকীকরণের জন্য চাপ প্রয়োগ করছে।
Su-35 জেটগুলো ইরানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো উন্নত রাডার এবং দীর্ঘ-পরিসরের অস্ত্র বহন করতে সক্ষম। তবে, রাশিয়ার বিলম্ব এবং অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতির কারণে ইরান চীনের J-10C জেটের দিকে ঝুঁকছে, যা তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী এবং পাকিস্তানের বিমান বাহিনীতে ইতিমধ্যে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব
ইরানের Su-35 অধিগ্রহণ মধ্যপ্রাচ্যের শক্তি ভারসাম্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। ইসরায়েলের অত্যাধুনিক F-35I জেটের বিপরীতে Su-35 কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, এটি ইরানের বিমান বাহিনীকে একটি উল্লেখযোগ্য শক্তি বৃদ্ধি করবে। তবে, রাশিয়ার উপর নির্ভরতা এবং চীনের সাথে নতুন সম্পর্ক তৈরির প্রচেষ্টা ইরানের কৌশলগত অবস্থানকে জটিল করে তুলছে। রাশিয়ার প্রতি ইরানের ক্রমবর্ধমান হতাশা এবং চীনের দিকে ঝুঁকে পড়া মস্কো-তেহরান সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারে।

উপসংহার
ইরান-রাশিয়া Su-35 চুক্তি নিশ্চিত হলেও, এর বাস্তবায়ন এখনও অনিশ্চয়তার মুখে। রাশিয়ার সরবরাহে বিলম্ব এবং ইরানের চীনের দিকে ঝুঁকে পড়া এই চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই চুক্তি কীভাবে বাস্তবায়িত হয় এবং এর ফলে ইরানের বিমান বাহিনী কতটা শক্তিশালী হয়, তা আগামী দিনগুলোতে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন